পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১২

যোগাযোগ মন্ত্রীর পদচ্যুতি: কেন ঈদের দিন শহীদ মিনারে প্রতিবাদী অবস্থান


robaet-fপ্রিয় পাঠক, আপনারা জানেন বাংলাদেশে গেলো কয়েক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারাচ্ছি প্রিয়জনদের। একটি মৃত্যু একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না। কোনো কোনো মৃত্যু পুরো দেশের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। গত ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, বাংলাদেশের আধুনিক সম্প্রচার সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ মিশুক মুনীরসহ পাঁচ জন নিহত হন। এর আগে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০ জন শিশু নিহত হয়। আমরা মনে করি এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়। সড়ক ও পরিবহন খাতে দীর্ঘ অব্যবস্থাপনা, সীমাহীন দুর্নীতি, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, অবৈধ পন্থায় গাড়ি চালনার লাইসেন্স প্রাপ্তি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের অনুমতি, সড়ক-বিভাজক না থাকা, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা, ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈজ্ঞানিক সড়ক নির্মাণ এবং সর্বোপরি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতার অভাব আজকের বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তাই, আমাদের প্রতীতি, বাংলাদেশে দুর্ঘটনার নামে আসলে প্রতিদিন সড়কে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। স্কুল পড়ুয়া শিশু থেকে বিশ্ব বরেণ্য চলচ্চিত্রকার কেউ-ই এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আমরা যে কেউ যেকোনো দিন এর নির্মম শিকার হয়ে যেতে পারি; কেবল নিহত নয়, ফি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আরো কয়েক হাজার মানুষকে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্বের জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
আমরা মনে করি যেকোনো সভ্য রাষ্ট্রের জন্য এটা লজ্জার। কোনো বিবেকবান মানুষই এ অবস্থা মেনে নিতে পারে না। আমরাও পারি নি। একান্তই বিবেকের তাড়নায় গড়ে তুলেছি ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী-জনতার সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা এ রাষ্ট্রে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই। এ লক্ষ্যে গত ২৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরা একটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিলাম। সারা দেশের অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ফেসবুক, ই-মেইল ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। তাঁরা বিভিন্নভাবে আমাদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন। তাঁদের সমর্থন আমাদের কাজ ও দায়িত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে; এ লেখার মাধ্যমে মাধ্যমে তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং সেই দায়িত্বের প্রতি অনুগত ও সংবেদনশীল থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
আপনারা জানেন যেকোনো সভ্য রাষ্ট্রে দুর্ঘটনা ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা ব্যক্তি তাঁর দায় স্বীকার করে নিজ পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌল বৈশিষ্ট্য হলো প্রশাসনের সর্বত্র জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা; দুঃখজনক যে সড়ক ও পরিবহন খাতে দীর্ঘ অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে দিনের পর দিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ নিহত হচ্ছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোনো প্রতিকার প্রতিবিধান বা দায় স্বীকারের কোনো নজির স্থাপিত হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা ব্যক্তিদের সবাই কেবল একে অন্যের কাঁধে দোষ চাপানোর নিম্ন্ সাংস্কৃতিক রুচির পরিচয়ই দিয়ে গেছেন। এ অভিযোগ থেকে বর্তমান বা অতীতের কোনো সরকারই মুক্ত নন। আমরা মনে করি এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না; আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে এ অবস্থাকে আমরা তাই চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছি। এ জন্য আমরা ২৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের প্রতিবাদ সমাবেশে উচ্চকিত হয়েছিলাম এই বলে যে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহত হওয়ার ঘটনার দায় রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রধান দাবি ছিল আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদচ্যুত করতে হবে।
আমরা মনে করি, দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার বোধ থেকে মর্যাদাবান মানুষেরা তাঁদের দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করেন, বিশ্বে এর নজীর প্রচুর; কিন্তু দুর্ঘটনার পর কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও যোগাযোগ মন্ত্রী পদত্যাগ করেননি, তাই আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যোগাযোগ মন্ত্রীর পদচ্যুতির দাবি তুলেছিলাম এবং আশা করেছিলাম এর মাধ্যমে রাষ্ট্রে জবাবদিহিতার একটি কাঠামো তৈরির শুভ সূচনা হবে। শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে আমরা কর্মসূচি হিসেবে ঘোষণা করেছিলাম, যদি ৩১ আগস্টের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রীকে পদচ্যুত করা না হয় তবে ঈদের দিন শহীদ মিনারের পাদদেশে দুপুর ১২:৩০ থেকে বিকেল ৪:৩০ পর্যন্ত আমরা প্রতিবাদী অবস্থান নেব এবং আমাদের দাবি তুলে ধরব।
শহীদ মিনার এ  দেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রতিবাদী চেতনার প্রতীক। এ জন্য প্রতিবাদের স্থান হিসেবে আমরা শহীদ মিনারকে বেছে নিয়েছি। শহীদ মিনারে আমরা কোনো ঈদ-উৎসব করছি না বরং মহাসড়কগুলোর অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক মানুষ যারা এবার ঈদে বাড়ি ফিরতে পারেন নি, মিলিত হতে পারেন নি পরিবার পরিজনদের সঙ্গে, ঈদের উৎসব বর্জন করে শহীদ মিনারে প্রতিবাদের মাধ্যমে তাদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা জানাবো। ঈদের উৎসব বর্জন করে শহীদ মিনারে আমরা প্রতিবাদী অবস্থান নেব। প্রতিবাদী গান, কবিতা ও বক্তৃতার মাধ্যমে আমাদের দাবি ও অবস্থান তুলে ধরবো। এ পর্যায়ে সরকারের কাছে আমাদের দাবিসমূহ পুনর্ব্যক্ত করছি :
এক. আমাদের প্রধান দাবি ৩১ আগস্টের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদচ্যুত করতে হবে।
দুই. অবৈধ লাইসেন্স প্রাপ্তির প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।
তিন. সড়ক ও পরিবহন সেক্টরের দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চার. গণপরিবহন ব্যবস্থায় দ্রুত শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
পাঁচ. সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিদ্যমান আইনটি কঠোর করতে হবে।
ছয়. চালকদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সাত. সড়ক ও পরিবহনসহ প্রশাসনের সবস্তরে কার্যকর জবাবদিহিতার কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আমরা সরকার বা কারও প্রতিপক্ষ নই। আমরা দেশের সাধারণ নাগরিক। এই দেশের রাজনীতিবিদেরা ঘুমিয়ে আছেন। আমরা তাঁদের ঘুম ভাঙাতে চাই। এ কারণেই আমরা ঈদের দিন শহীদ মিনারে গিয়ে প্রতিবাদী অবস্থান নেব। ৩১ আগস্টের এখনও কয়েক ঘন্টা বাকি, এর মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদচ্যুত না করা হলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে দুপুর ১২:৩০ থেকে বিকেল ৪:৩০ পর্যন্ত প্রতিবাদী অবস্থান পালন করব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব। সড়কে মানুষ হত্যা বন্ধে সর্বস্তরের জনতাকে প্রতিবাদী অবস্থানে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

রোবায়েত ফেরদৌস
: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক।